সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

কিছু কিছু দেখা

আমি বেশি কিছু দেখিনি, কিন্তু কিছু কিছু দেখেছি - খুব ভালো লাগে|

সে অনেক দিন আগের কথা ...

উহু রুপকথা নয়, আমি তখন তিন চার বছর - কোলাঘাটে থাকি| আমার বাবা বাইকের ডায়নামো ডিসএসেম্বেল করছিলো - ওয়ারিং মনে রাখতে একটা কাগজে এঁকেও রাখছিলো সাথে সাথে| আমিও বাবার দেখা দেখি আরেকটা কাগজে সেই রকম আঁকিবুঁকি করতে শুরু করলাম| বাবা আমার বাহাদুরি দেখে পরের মাসেই আঁকার স্কুলে ভর্তি করে দিলো|

সেই স্কুলে কিরকম কি দেখেছি, বেশিরভাগই ভুলে গেছি| তবে আমায় প্রথমেই একটা ইঁদুর আঁকতে দিয়েছিলো সেটা মনে আছে - আর সেটা 'কেন করবো' মনে করে নকল করতে করতে দেখছিলাম পাশে আর একটা বড় ছেলে 'ঘরের মধ্যে পড়তে বসেছে, এরকম একটা ছেলের লাল জামার নিচে সাদা প্যান্টে' আচ্ছা করে সাদা প্যাস্টেলই ঘসছে|

আমি বোকার মতো জিজ্ঞাস করলাম 'কাগজেই তো সাদা আছে!' সে আমার বোকামি শুধরে দিলো - 'উহু আরও সাদা করতে হবে|'

কিন্তু সেই ছবিতে কমলা ছাদ, খয়েরি বাক্স আর বাইরের কচি-কলাপাতা-সবুজ মাঠের ওপারে গাড় সবুজ ঝোপঝাড় দেখে খুব সুন্দর লেগেছিলো - মনে আছে|

তারপর কি হলো জানিনা - মনে নেই আমার - পাঁচ বছর বয়সে বসিরহাট এলাম| ভাড়াবাড়িতে থাকাকালীন সেখানকার অন্য প্রতিবেশী রুবিদিদি আর কোন একটা দিদিকে ছবি আঁকাত একজন আঙ্কেল - Sankar Sarkar| তিনি একদিন দিদিদের একটা ময়ুর এঁকে দিচ্ছিলেন - স্পষ্ট চোখে ভাসে, গাড় সবুজের সাথে গাড় নীল গুলে তাতে সামান্য একটু লাল মিশিয়ে নিয়ে ময়ুরের গলায় বুকে তুলি বোলাতেই কি সুন্দর একটা নিকষ কিন্তু চকচকে একটা ম্যাজিক হলো - আলাদা করে ময়ুরপন্খ্সি মনে রাখার দরকার হয় নি আর কোনদিন|

ঐ বাড়িতেই সুধাংশু দাদার কাছে এককাঁড়ি দারুন ভালো ভালো বই ছিল| বানান করে নাম পড়া যেত 'ইন্দ্রজাল কমিক্স' - তার কোন একটার মলাটে কি অদ্ভুত ছবি ছিল একটা - মস্ত বড় আপেল! তার মধ্যে একটা জেলখানার দরজা আঁকা আর তার ভিতর একটা দুষ্টু লোক দাঁড়িয়ে আছে! ভিতরে পড়ে পড়ে বুঝেছিলাম ওটা মোমের আপেল - যারা জানে তারা বুঝবে, কিন্তু আমি বেজায় লোভ ছিল কোনো একদিন মোমের আপেল খাবো!

একটা লোক ছিল - বিভত্সো ভয়ংকর - মোটা মোটা চোখ, সব সময়ে মুখ হাঁ করা - হাফ শার্ট আর পাজামা! হাইস্কুল মাঠের পাশ দিয়ে এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেঁটে হেঁটে আসতো আর তাকে দেখলেই আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যেত! একবার বসিরহাট টাউন হলে আমার জীবনের প্রথম আঁকা প্রতিযোগিতায় মা আমাকে নিয়ে গিয়েছে - আমাকে যেখানে বসিয়ে দিলো তার ঠিক পিছনেই দেখি সেই ভয়ংকর লোকটা!

আঁকা দুরে থাক আমি সেখান থেকে পালাতে পারলে বাচি এরকম অবস্থা! বার বার কানের পাশের চুলগুলো খাঁড়া খাঁড়া হয়ে যাচ্ছে - সবসময়ে মনে হচ্ছে লোকটা যদি পিছন থেকে হাত বাড়ায়!!

ভয়ে ভয়ে পিছন ফিরে একবার লোকটাকে দেখতে গিয়ে তার কাগজে তাকিয়ে আর চোখ ফেরাতে পারি না! সে লোকটা তার ব্যাঁকা হাতের আরষ্ট আঙ্গুল দিয়ে কি সুন্দর একটা নদী আঁকছে, তার পাশে ইঁটের দেওয়াল আর তারও সামনে লাল লাল ফুল ভরা ঘন সবুজ বাগান!

নিজের কাগজে কি করেছিলাম - উহু মনে নেই - কিন্তু তারপর থেকে সেই লোকটাকে ভয় পাওয়া দুরে থাক - মনে মনে ম্যাজিশিয়ান বলেই মানতাম|

বসিরহাটে ক্লাস থ্রিতে পড়ি যখন, সেসময়ে ভাড়াবাড়ি ছেড়ে নিজের বাড়ি হলে নতুন বাড়ির কাছাকাছি প্রান্তিক ক্লাবে আঁকার ক্লাসে 'ছোট মাস্টারের' কাছে আমায় ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো| সেখানেও কি দেখেছি সেরকম কিছুই মনে নেই আমার - কিন্তু আবার একদিন ম্যাজিক দেখলাম যখন 'বড় মাস্টার' আরেক দাদার ছোট করে কাটা আর্ট পেপার পুরো জলে ভিজিয়ে তার উপর চওড়া তুলি দিয়ে আলতো করে একটু কোবাল্ট ব্লু টেনে দিতেই কেমন সুন্দর একটা মেঘ মেঘ আকাশ হয়ে গেলো!

গুটি গুটি করে আস্তে আস্তে ক্লাস সেভেন-এইট-নাইন-টেন করে দেখলাম কিছু, করতে চেষ্টাও করলাম কিছু, কিন্তু সেভাবে হলোও না তেমন কিছু| যাকগে -

তবে ইলেভেন-টুয়েলভ নাগাদ আরেক বড় মাস্টারের কাছে একটা ছেলে এসছিল আঁকা শিখতে| সে আমাদের থেকে আরেকটু বড় - বিএ-টিএ পাশ-ফাস করে চাকরি বাকরি'র চেষ্টা না করে ধেড়ে বয়সে হিজিবিজি করতে শুরু করেছে| চোখ ফুটেছে তখন আমার সামান্য - বুঝতেও শিখেছি কিছু কিছু - সে ছেলের আঁকার বাহার দেখে মনে মনে মুচকি হেসেছি এরকম করলে আর কোথাও চান্স পেতে হবে না বাপু|

অনেকদিন পরে এক একজিবিশনে কি সাংঘাতিক একটা জিনিস দেখি! অপূর্ব সুন্দর মারাত্মক একটা ঘোঁড়া - কিসে আঁকা মনে নেই - কিন্তু মনে হচ্ছে যেন জীবন্তের থেকেও আরও বেশি কিছু, আঁকার থেকেও অনেক বড় - অনেক মহত্তর ম্যাজিক! Gobinda Nandi আমার থেকে গুনে তো অবশ্যই - বয়সেও একটু বড় হলে ওকে আমি নাম ধরেই ডাকি - আমার দেখা সব থেকে সেরা শিল্পী|

না - মানুষ জনের স্তুতি করবার জন্যে এতসব লিখতে বসিনি - সে সময়ও নেই - আর যারা সত্যি ম্যাজিশিয়ান তাদের এসব লাগেও না| ফিরিস্তি লিখতে গিয়ে এর মধ্যেই দু-তিনবার এডিট করেছি - আরও টুকরো কিছু লিখছিলাম আর আরো অনেককেই মেনশন করছিলাম, সব বাদ দিয়ে শুধু সেই জিনিশ্গুলোকেই রাখছি যেসব গুলো দুর্গাপুজোর আগে আগে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে বিকেলের হলদেটে রোদ সারা ছাদ জুড়ে চিকিমিকি খেলার সময়ে রেলিঙ আর চিলেকোঠা'র দেওয়ালের কোনে যেখানে কানের পাশ দিয়ে হালকা হাওয়া বয়ে যায় সেখানে হেলান দিয়ে বসে দিয়ে শুকতারার পাতায় Dilip Das-এর আঁকা অদ্ভুত লাল দেওয়ালের ছবি দেখবার মতোই সুখ-সুখ রোমাঞ্চকর|

সত্যিই আমি বেশি কিছু দেখি নি - দেখতে পারিও নি - কিন্তু এই কিছু কিছুতেই চলে যাবে আমার হয়তো|

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

উত্তরাধিকার ওয়েব সাহিত্য পুরস্কার

একটু নয়, প্রচুর দেরি করেই – ইয়ে কি বলে আবার একটু ঢাক পেটাপিটি করি| তবে সেদিক থেকে ধরতে গেলে ভবিষ্যতে আমার ডিজে হওয়ার রাস্তাও খুলছে হয়তো পরোক্ষ ভাবে| আসল সাফাই হলো ‘আমার মতো’ যারা কাজ করেন, তারা হয়তো উপলব্ধি করেছেন যে এপ্রিল মে থেকে কাজের স্বাভাবিক চাপ শুরু হয় আর তা বাদে যেহেতু ব্যক্তিগত ভাবে আমার পুরস্কার-টুরস্কার পাওয়ার সেরকম অভ্যাস নেই, সেই দিক থেকে - তবে ঘটনা, একবছরে পরপর দুবার পুরস্কার প্রাপ্তি আর তার সাথে ইদানীন গপ্পো লেখারও ঝোঁক বেড়েছে খানিক, কাজেই সবে মিলে ... যাকগে! জ্ঞানীগুনী যারাই আছেন তাদের কাছে ব্যাখ্যা করার দরকার না হলেও, সাধারণ মানুষ হয়তো কৌতুহলী হবেন যে এই উত্তরাধিকার ওয়েব সাহিত্যের ব্যাপারটা কি! দেখুন, মানুষ একটি অদ্ভুত জন্তু – সেভাবে বলতে গেলে এদের রাম-টু-রম রেশিও অন্যান্য জন্তুর তুলনায় অনেক বেশি মানে একোয়ারড মেমরির থেকে প্রিন্টেড মেমরি অনেক কম| জীবন বিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা খুবই কম, তাও আমার সেকেন্ডারি ব্রেন, মানে ইন্টারনেট থেকে যা জানা, মানব মস্তিষ্কের ডানদিক আমাদের সাথে বেজায় মজার মজার খেলা খেলে! কল্পনা, সৃজনশীলতা – এগুলি অন্য জন্তুদের ভিতর সেভাবে প্রকট কি? হয়ত

নতুন এডভেঞ্চার

“সারাজীবন কলম পিষে কাটাতে চাও নাকি – হ্যাহ? ভালো!” সমুকে তার ব্যাগ থেকে তার বইয়ের পাঁজা বের করতে দেখে পল্টন বললো| “কেন? তুমি কি করতে চাও?” আশ্চর্য্য হয়ে জিজ্ঞাস করলো সমু| “আমার ভাই ওসব পোষাবে না – আমি চাই এডভেঞ্চার! সারাজীবন অফিস-কাছারিতে মুখ গুঁজড়ে পড়ে থেকে চাকরি বাকরি করা – এহে, সে আমার ধাতে নেই| যারা জীবনে চ্যালেঞ্জ নিতে পারে না, তাদের হয়তো … যাক গে!” হাত উল্টোল পল্টন| এরকম খাপছাড়া ছেলের সাথে একসাথে অনির্দিষ্ট কালের জন্যে একটা বাড়িতে একসাথে থাকতে হবে, সেটা ভাবলেই সমু রীতিমতো তিতিবিরক্ত হচ্ছে| কিন্তু এছাড়া তো আর কোনো উপায়ও দেখা যাচ্ছে না – সমু’র মাসি-মেসো তার মাসতুতো দিদির বাড়ি নিমন্ত্রনে গিয়েছে, মাসতুতো দাদা সৌগতকে ব্যবসার কাজে অন্য শহরে না গেলেই নয় – বাড়ি ফাঁকা| সমু কলেজ শেষ করে আপাতত বেকার, চাকরি-বাকরির পরীক্ষা দিচ্ছে, সৌগত তাকে বলেছিলো যে অন্তত মাসি-মেসো ফেরা অব্দি সে যদি তাদের বাড়ি থাকতে পারে| গ্রাজুয়েশনের পর থেকে এযাবত কেবল বাড়ি-কোচিং সেন্টার, কোচিং সেন্টার-বাড়ি করে সমুও হাঁফিয়ে উঠেছিলো, কাজেই এমন একটা আউটিংএর সুযোগ পেয়ে সেও লাফিয়ে উঠলো| সেই মতো সমু এক সপ্তাহের মতো জামাক