সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ষষ্ঠ গোয়েন্দা

আমি তখন অনেক ছোট - ক্লাস ওয়ানে পড়ি| তখনো আমাদের নিজেদের বাড়ি হয়ে ওঠেনি - থাকতাম বসিরহাট হাই স্কুল মাঠের পাশে এক ভাড়া-বাড়িতে| বাবা চাকরিসূত্রে বিহারের চান্দিল বলে এক জায়গায়| পক্ষান্তে-মাসান্তে একেকবার ফিরতেন আর তখন আমাদের ভারী মজা| সেরকম একবার বাবা যখন এলেন, তখন শীতকাল, আর সবাই মিলে একদিন চলে এলাম কলকাতা বেড়াতে - জাদুঘর দেখা হয়নি, চিড়িয়াখানা, তারামণ্ডল দেখে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ঘুরে তারপরে বাড়ি| সেই আমার প্রথম কলকাতা ভ্রমণ| চাকরি সুত্রে পরবর্ত্তীকালে কলকাতায় এসেছি, থেকেছি, সেবারের মতো সেই চমতকার সুন্দর রংচঙে শহরটা খুঁজতে চেয়েছি, কিন্তু হতাশ হয়েছি - সেরকমটা আর দেখতে পাই নি|

মনে আছে বাবা একটা 'হাওয়ায় চলা' খেলনা কুকুর কিনে দিয়েছিলেন| লাল রঙের প্লাস্টিকের এইটুকুন একটা কুকুর, তার ভিতরে একটা হাপরের মতো জিনিস আছে, লম্বা নল দিয়ে আর একটা হাপরের সাথে লাগানো, বাইরেরটায় চাপ দিলে ভিতরেরটা ফুলে-ফেম্পে উঠে কুকুরের হাত-পা চালিয়ে সেটাকে এগিয়ে নিয়ে যেত| তার সাথে বাঁশি-ধরনের কি একটাও লাগানো ছিল - আসল কথা 'গুহ্যদ্বারে' হাওয়া খেললেই কুকুর পিক-পিক করে ছুট লাগত| দিব্যি মজা করতাম ওটা নিয়ে - অবশ্য আমার মতো সর্বকর্মার হাতে কুকুরের পঞ্চত্ব-প্রাপ্তি হতে বেশ সময় লাগেনি - দুবছর পরেই ঐ কুকুরের 'প্রাণবায়ু-প্রদানকারী' পাইপ আর তারসাথে খেলনা টেলিফোনের পাইপ জোড়া দিয়ে 'দুনিয়ার সেরা' ঝরনা তৈরী করেছিলাম|

যাইহোক, আসল মজা ছিল কিন্তু ফেরবার সময়ে - ট্রেনে জবরদস্ত ঝাল দেওয়া মশলামুড়ি আর তারপরে সেই ঝাল ছাপা দিতে দেলখোশ খাওয়া হলো - এক হকারের কাছ থেকে বাবা আমায় একটা দারুন জিনিস কিনে দিলেন - তার নাম 'শুকতারা'|

আগেই বলেছি আমি লিখতে পড়তে শিখি অনেক ছোটবেলাতেই, এর আগেই 'ইন্দ্রজাল কমিকস' পড়া শুরু করেছি, 'বাঁটুল দি গ্রেট' ৩, ৪ ইত্যাদি হস্তগত হয়েছে - কাজেই প্রথমেই চোখ গেলো বাঁটুলএ আর তারপরে ফরফর করে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে পেলাম বাহাদুর বেড়াল - রঙ্গীন বলে সহজেই চোখে ধরেছিলো, আর তাবাদে বন্ধুত্ব হয় 'হাঁদা ভোদা'র সাথে| ট্রেনেই বসে বসে সব কমিকস পড়ে ফেলি|

আমি যেদিন ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হই, তার দিনকয়েক পরেই আমার সাথে পরিচয় হয় শামিম হুদা'র, পরিচয়ের মাধ্যমও বেশ চমকপ্রদ - মনে নেই আমি না শামিম, কে যেনো বাঁটুল দি গ্রেটের কভার দিয়ে বইতে মলাট দিয়ে নিয়ে এসেছিলো - তার থেকেই আলাপ ও বন্ধুত্ব| বিশ্বাস করবেন না - সেইসময় থেকে এতদিন, প্রায় তিরিশ বছর হয়ে গেল আমাদের সেই বন্ধুত্ব এখনো অটুট! ছেলেবেলায় আমি ছিলাম রোগা আর শামিম মোটা না হলেও বেশ হৃষ্ট-পুষ্ট - 'হাঁদা-ভোদা' পড়তে পড়তে নিজেকে কল্পনা করে ফেললাম হাঁদা আর শামিম হয়ে গেলো ভোদা| একটু কষ্ট হয়েছিল - কারণ আমি মোটেই হাঁদার মতো দুষ্ট বালক ছিলাম না - তাছারা নামের মানে নিয়েও একটু খুঁত-খুন্তুনি ছিল|

শুকতারার পাতায় আমার সাথে পরিচয় হলো পাঁচটি ছোট-ছোট ছেলেমেয়ে আর একট কুকুরের| ছবিতে গল্প ছাড়া শুধু গল্প হিসাবে আমি প্রথম পরি পান্ডব গোয়েন্দা - ওটা একটা ধারাবাহিকের অন্তিম পর্ব ছিল - গল্পটা মনে নেই এখন, তবে মনে আছে শেষ লাইনে ছিল 'থ্রি চিয়ার্স ফর পান্ডব গোয়েন্দা - হিপ হিপ হুররে!' প্রথম বন্ধনীর মধ্যে সমাপ্ত দেখে মাকে মানে জিজ্ঞাস করেছিলাম - গল্পটা শেষ হয়ে গিয়েছে শুনে প্রচুর দু:খ পেয়েছিলাম, কিন্তু আমার আগ্রহ দেখে বাবা আবার কাজে ফেরার আগে আমাদের স্থানীয় খবরের কাগজ-ওয়ালার সাথে মাসে-মাসে 'শুকতারা'র কথা বলে দিয়ে গিয়েছিলেন| তার পরের মাসে আবার পান্ডব গোয়েন্দা'র নতুন উপন্যাস শুরু হতে দেখে দারুন আনন্দ হয়েছিল| ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের কাছেই জানতে পারি অপরাধী কারা, গোয়েন্দা কি জিনিস, তদন্ত কাকে বলে ইত্যাদি ইত্যাদি|

বছর-দেড়েক পরে যখন আমাদের নিজের বাড়ি তৈরী হলো, তখন পুরনো স্কুল আর বন্ধুবান্ধব - মানে শামিম আর কি - ছেলেবেলায় আমার অন্তর্মুখিনতার কারণে সেই স্কুলে সেরকম বন্ধুত্ব আর কারু সাথে সেরকম তৈরী হয় নি - সব ছেড়ে বসিরহাট কলেজ-পারায় চলে এলাম| নিজেদের - মানে 'একদুম' আমাদের বাড়ি তার একটা বিশাল আকর্ষণ ছিলই, কখনো বাবার কখনো মার সাথে সেই নির্মীয়মান ইট-বালি-সিমেন্টের কঙ্কালের দিকে তাকিয়ে কল্পনা করতাম যে এখানে আমার নিজের একটা ঘর থাকবে| বাবা'র কাছে আবদার করেছিলাম যে আমার একটা লাইব্রেরী বানিয়ে দেওয়া হোক| বাবা হেসে মিছি-মিছি 'হ্যা' বলেছিলেন - তখন বাথরুমের জন্যে যে ছোট অংশ সেটা দেখে মনে মনে ভেবে নিয়েছিলাম - 'ব্যাস' এরকম একটা জায়গা পেলেই চলবে আমার| তিনটে দেওয়ালে বইয়ের তাক থাকবে - ওতেই সব কমিকস আর শুকতারা ধরে যাবে মোটামুটি|

নতুন বাড়িতে আসবার পরপর নতুন স্কুলে ভর্ত্তি হলাম| আগে ছিলাম 'বসিরহাট প্রাইমারি' তার থেকে চলে এলাম 'মৃজাপুর মহাকালী প্রাথমিক বিদ্যালয়' - উহু, স্কুলের নাম শুনে আর চেহারা দেখে সেরকম পছন্দ হয়নি প্রথমে, একটু যেনো কিরকম-কিরকম - আগের স্কুলের মতো চকচকে বড়সড় বাড়ি নেই, বাইরে আবার দর্মা আর চাঁচের দেওয়াল, আলাদা আলাদা ক্লাসের জন্যে আলাদা আলাদা ঘর নেই, একটাই বড় ঘর তার ভিতরেই সব ক্লাস চলছে একসাথে, ইউনিফর্ম একটা আছে বটে, তবে বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই টাই বা ব্যাজ পরে না - প্রচুর মন খারাপ হয়েছিল 'মৃজাপুর মহাকালী' দেখে| কিন্তু দুদিন যেতে না যেতেই সৌম্য দাস, মিঠুন চক্রবর্তী, পরাগ মৈত্র, সুদেষ্ণা ব্যানার্জি - এরা যেভাবে আমায় আপন করে নিলো, স্কুল ছুটি থাকলে প্রচুর দু:খ হত আমার| নতুন স্কুলে প্রচুর বন্ধু-বান্ধব পেয়েছিলাম আমি আর এদেরই অন্তরঙ্গতায় আমার অন্তর্মুখি মনোভাব কেটে গিয়েছিলো অনেকাংশেই|

মৃজাপুর মহাকালিতে 'হেড মাস্সাই' ছিলেন বৃন্দাবন বাবু| উনি অঙ্ক করাতেন, আপাত ভাবে প্রচন্ড নৃসংশ ছিলেন ব্যবহারে - মনে আছে একবার আমাদের এক সহপাঠিনীকে তুলে প্রায় আছর মারবার মতো ফেলে দিয়েছিলেন| বললে বিশ্বাস করবেন না ওনার আতঙ্কেই পরের হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষায় অঙ্কে একসয় একশো পেয়েছিলাম! প্রাইমারি স্কুল শেষ হলে উনি আমার মাকে বলেছিলেন যে জীবনে কিছু করতে হলে অঙ্ক আর ইংরাজিতে জোর দেওয়া দরকার - এখনও ওনাকে স্মরণ করি আতঙ্কে নয়, শ্রদ্ধ্যায়|

বৃন্দাবন বাবু'র কথায় আরেকটা জিনিস মনে পরে গেলো - একদিন উনি স্কুলে আসেননি, দিনদুয়েক বাদে যখন স্কুলে এলেন তখন পরনে অসৌচের পোশাক - ধুতি আর উড়নি, সেই দেখে একটি ছেলে চুপিচুপি আমায় বললো যে 'যাক চিন্তা নেই' এখন ওনার অশৌচ চলছে - দিন পনেরো আর উনি ঠ্যাঙ্গাবেন না! আগে কোনো আত্মীয়-বিয়োগ হয়নি, অশৌচ কি জিনিস জানতাম না - তবে ঐ ছেলেটি'র কথায় মনে হলো যেনো সাপের পাঁচ পা দেখতে পেলাম| ইচ্ছা করে অঙ্ক ভুল করতে পারতাম না, তবুও আগে যে শংকা নিয়ে অঙ্ক খাতা জমা দিতাম - এবার মনে হলো দিন পনেরো তার থেকে নিশ্চিত! সত্যিই 'হেড মাস্সাই' যেনো অন্য কেউ ছিলেন ঐ কদিন| ওনার মাতৃ বিয়োগে আমাদের সাময়িক স্বস্তি - পরে এই বিষয় অন্তর্করণ প্রচুর জ্বালিয়েছে|

নতুন বাড়িতেও নতুন খবরের কাগজওয়ালা নিয়মিত ভাবে 'শুকতারা' সরবরাহ করেছে| জেনে আশ্চর্য হয়ে গেলাম আমার নতুন বন্ধুরা সবাই আমার সমমনস্ক! সৌম্য, মিঠুন, বাবলি মানে সুদেষ্ণা, পরাগ - সবাই আমার মতই শুকতারা 'গেলে'! পূজার ছুটি'র আগেই শারদীয়া হাতে চলে আসতো, স্কুলে রীতিমতো প্রত্যোগীতা চলতো কে আগে কটা গল্প উপন্যাস পরে শেষ করতে পেরেছে তাই নিয়ে|

ইতিমধ্যে আমি ফের ছবি আঁকা শেখা শুরু করেছি, 'স্যারেদের' দেওয়া গাছের ধারে নৌকোয় বসা মাঝি, বা গ্রামীন পথ ধরে কলসি কাঁখে নিয়ে হেঁটে যাওয়া গ্রাম্য বধু - তাদের থেকে খাসা লাগতো দিলীপ দাসের আঁকা পান্ডব গোয়েন্দা'র ছবি বা নারায়ন দেবনাথের আঁকা সব্যসাচী'র টারজান| আরো দুর্দান্ত লাগতো শারদীয়া শুকতারায় আমাদের বসিরহাটেরই মানুষ পরেশ ভট্টাচার্য-এর সুন্দরবন-সম্পর্কিত উপন্যাস বা বড়গল্পে ময়ুখ চৌধুরীর নানা ছবি, বা প্রসাদ রায় ছদ্মনামে হলেও দেখলেই চিনতে পারতাম এটা তার আঁকা না হয়ে যায়ই না! তবে সবথেকে ভালো লাগতো বন্দুক-পিস্তলের ছবি আঁকতে - যদি কেউ কোনদিন আমার সেই সব সময়ের খাতা বই আবিষ্কার করেন তবে আমি নিশ্চিত যে তিনি ভেবেই রাখবেন যে এ ছেলে স্যামুয়েল কোল্টএর বংশধর বা কালাশনিকভের আত্মীয় না হয়ে যায় না|

আগের স্কুলে আমি আর শামিম ঠিক করেছিলাম যে বড় হলে, হাতে পয়সা-করি পাওয়া গেলে প্রথমেই একজোড়া পিস্তল কিনতে হবে - একজোড়া না হলে চলে না - যেরকম বেতালের আছে| তারপরে সুযোগ সুবিধা মতো একখানা ঘোড়া জোগার করতে হবে - কুকুর নিয়ে সেরকম সমস্যা নেই, যদিও ছেলেবেলায় কুকুরে আমার বেজায় ভয় ছিল, তাসত্বেও রাস্তা থেকে একটিকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে আসতে পারলেই হবে| শীতকালে স্কুলে যেতে ফুল-প্যান্ট পরতে পেতাম, তখন যেকরেই হোক মায়ের চোখ এড়িয়ে চেষ্টা করতাম প্যান্টের পা মোজা'র ভিতরে ঢুকিয়ে নিতে - সোয়েটারের কব্জিতে লম্বা লম্বা দাগ-কাটা না হলে মন ভরত না - সেকারণে মায়ের হাতে বোনা উলের সোয়েটার অসহ্য ছিল| বেতালের যে ওরকম হয় না! তবে চরম হিংসা করতাম 'বাবলু'কে| যদিও অভাবে আমার একটা পিস্তল ছিল তবে সেতো ক্যাপ ফাটানো'র| বাবলুর মতো 'সত্যি সত্যি' রিভলবার তো নয়? ভাবতাম কি করে বাবলু ওরকম 'সত্যি সত্যি' জোগার করলো? প্রচুর দিন বাবা-মার কাছে বায়নাও করেছিলাম যাতে করে অন্তত এক-খানা 'সত্যি সত্যি' পিস্তল বা রিভলবার আমাকে দেওয়া হয়| তার জন্যে প্রানপন বা ভালো রেজাল্ট - যেটাই হোক না কেন আমি রাজি|

একমাত্র ছেলে হওয়ার কারণে ছেলেবেলায় প্রতি বছরই বাবা ও মা বিশেষ যত্নে আমার জন্মদিন করতেন| সকাল থেকেই পড়ার ছুটি তো ছিলই, তাবাদে পায়েস, মুরগির প্রাণহানি এসব ছাড়াও একটা করে আংটি আর সবাই মিলে একটা ছবি তোলা হত| আংটিটা নিয়ে আমার প্রচুর সমস্যা ছিল - চাইতাম তাতে যাতে একটা মড়ার খুলি আঁকা থাকে - তবে প্রতিবছরই এরকম আবদার করার সাথে-সাথেই প্রচুর ধমকানি জুটতো, ভাবতাম 'কুলক্ষণ'টা আবার কি জিনিষ?

যখন নিজের মতামত তৈরী হয়ে উঠতে শুরু করলো, তখন আমার উপহারের চাহিদা অন্যরকম হয়ে গেলো - মনে আছে যখন ক্লাস থ্রিতে পরি সেসময়ে বাবা জিজ্ঞেস করেছিলেন যে জন্মদিনে আমি কি চাই? যা চাইবো টাই দেওয়া হবে শুনে আহ্লাদে আটখানা হয়ে বলেছিলাম - বই| জানতাম পিস্তল বা মড়ার মাথা-ওয়ালা আংটি পাওয়া যাবে না, কিন্তু যার থেকে এসব হয় - সেই বই চাইলে কোনো অসুবিধা নেই| সেইমতো একসময়ে মা আমায় নিয়ে গেলেন লাইব্রেরিতে - ওখানে দেখে চমকে গেলাম যে পান্ডব গোয়েন্দা বই হিসাবেও পাওয়া যায়! সেবারে জন্মদিনে আমার পাওনা হলো 'কি-একটা-যেনো' 'নলেজ'-এর বই - আর তার সাথে সাথে 'পান্ডব গোয়েন্দা' ৬| কয়েকদিন আগে আমার স্ত্রী আমার বইয়ের সংগ্রহ ঘাঁটতে-ঘাঁটতে 'নলেজ কুইজ' বার করে ফেলেছিল, আমি ওকে তার ইতিহাস বলছিলাম - বিশ্বাস করুন সেসময়ে ওটা আমার দু চোখের বিষ ছিল - আমি মনে হয় কোনোদিন ওর পাতা উল্টেও দেখনি, তবে পান্ডব গোয়েন্দা ৬ - আমি এক-সপ্তহে প্রায় বার পনেরো পড়ে ফেলেছিলাম|

আমাদের এক বান্ধবী'র বাড়ি ছিল আমাদের স্কুলে যাওয়া আসার রাস্তার উপরেই - স্কুল ছুটি'র পরে একদিন তাদের বাড়ি গীয়ে আমি হতবাক! ওর কাছে পান্ডব গোয়েন্দা'র পুরো সেটটাই আছে - একেবারে এক থেকে নিয়ে শুরু করে পরপর সবগুলো! দেখেশুনে মনে হয়েছিল যে গোয়েন্দা না হয়ে তার থেকে ডাকাত হতে পারলে জীবনে আরও বেশি সুখ ছিল| ওর কাছ থেকে পরপর সবকটা বই নিয়ে পড়েছিলাম - মনে হয় আমাদের বন্ধুদের মধ্যে বই আদান-প্রদানের সেই সুত্রপাত|

যাই হোক - তখন আমরা ক্লাস ৩ বা ৪ এ হবে - একসময়ে মনে হলো যে গোয়েন্দা না হতে পারলে জীবনে আর কিছুই করা যাবে না| কিরকম একটা ধারনাও ছিল যে গোয়েন্দাদের 'এমনিতেই' বন্দুক পিস্তল থাকে| টর্চতো বাড়িতে আছেই, খাতার পাতা কেটে ছোট্ট নোটবুকও বানিয়ে নেওয়া হলো - দুয়েকটা 'কেস সলভ' করতে পারলেই থানা থেকে 'এমনিই' পিস্তল দিয়ে দেওয়া হবে| সৌম্য, মিঠুন, বাবলি, পরাগ এদেরও উত্সাহের অন্ত ছিল না সেসময়ে| তবে আশংকা আমার মতো সিরিয়াস ছিল না ওরা| পান্ডব গোয়েন্দা হতে গেলে অন্তত পাঁচজন লাগবেই - প্লাস কুকুর, কুকুরটা আবার বেতাল হওয়ার সময়েও কাজে লাগবে - সেরকমই অভিসন্ধি ছিল আমার, কাউকে জানতে দিইনি| তবে আমাদের দলে হচ্ছিলো মোটে জনা-চারেক - এই নিয়ে একটু মানসিক অশান্তি ছিল| মনে হয় সেসময়ে আরও কয়েকজনকে বলে দেখেছিলাম - যদি কেউ বিচ্ছু বা ভোম্বল হতে চায়| তবে সেরকম গোয়েন্দাগিরির শখ ক্লাসের আর কারু বিশেষ ছিল না বলে খুব দু:খিত হয়েছিলাম|

এক বন্ধুর উত্সাহ ছিল ভালই - 'গাড়ির নম্বর' দেখে অপরাধী ধরে ফেলা যায়, ব্যাস আমি আর সেই বন্ধু স্কুল ছুটি'র পরে লেগে যেতাম গাড়ির নম্বর টুকতে - খবরের কাগজে পরতাম যদি কোনো ব্যাঙ্ক ডাকাতের পালিয়ে যাওয়া গাড়ি'র নম্বর আমাদের টুকে রাখা নম্বরের লিস্টি'র মাঝে পাওয়া যায়, অন্তত পুলিশের কাছে আমাদের দেওয়া 'সুত্র' থেকে কোনো অপরাধের সুরাহা হয়! তবে পুরস্কারের বদলে রাস্তায় হা করে দাড়িয়ে বোকার মতো গাড়ি দেখার জন্যে মায়ের কাছে তিরস্কার জুটতো প্রচুর|

পান্ডব গোয়েন্দা'র সবথেকে হতাশার জায়গা ছিল বইয়ের ভিতরে থাকা 'এই লেখকের অন্যান্য বইয়ের' তালিকা| অভিশপ্ত তিদ্দিম, কাকাহিগর অভিযান, গিরিগুহার গুপ্তধন, ভাঙ্গা দেউলের ইতিকথা, হিন্দোল সর্দারের কেল্লা - নামগুলো পরলেই রক্ত গরম হয়ে যেত - ইচ্ছা করতো বাড়ি থেকে পালাই| বাবা-মায়ের উপরে রাগ হত কেন যে এরকম অখাদ্য জায়গায় আমাদের বাড়িটা বানানো হলো| একটা দুটো কেল্লা নেই, গড় নেই এমনকি একটা পোরো বাড়ি পর্যন্ত নেই| স্কুলে যাতায়াতের পথে নজর রাখতাম না-যেতে-পারা রাস্তা গুলো'র দিকে - বলা যায় না কোথায় কোন বাঁকে রহস্য লুকিয়ে আছে| জানতাম দিনদুপুরে কোনো সম্ভাবনাই নেই, তবুও বলা যায় না কোথায় কোন বাড়ির চিলেকোঠা'র জানালা থেকে উঁকি দেয় সবুজ মুখোশে ঢাকা একটা মুখ| এমনতো হতে পারে স্কুলে যাওয়ার চেনা রাস্তায় একটা অচিন গলির ওপাশেই দুর্জয় রহস্য অপেক্ষা করে আছে আমার জন্যে - হাজার হোক ভবিষ্যতের গোয়েন্দা বলে কথা| পর্যবেক্ষণের অভ্যাস তো রাখতেই হবে|

একদিন সেই বান্ধবীর কাছে খবর পেলাম যে তার এক দাদা নাকি গোয়েন্দা! শুনেতো আমি রীতিমতো শিহরিত! তার উপরে মনক্ষুন্ন হয়েছিলাম এরকম একটা কার্যকর তথ্য এতদিন চেপে রাখবার জন্যে| ঠিক হলো স্কুল ছুটি'র পরে একদিন যাওয়া হবে সে গোয়েন্দা-দাদা'র সাথে দেখা করতে| এলো সে মাহেন্দ্রক্ষণ| স্কুলের পরে যথারীতি সে বান্ধবী তার বইয়ের ব্যাগ বাড়িতে রেখে আমাকে নিয়ে তার মাসির-না-পিসির বাড়ি চললো - আমি যথারীতি বাড়িতে মাকে কিছু বলার সুযোগ পাইনি| সেই দাদা-কে দেখে সন্দেহ হলেও 'শ্রদ্ধা'ও তেমন কম হয় নি| যেনো-তেনো নয় - জলজ্যান্ত গোয়েন্দা বলে কথা! হোক না ক্লাস সেভেন বা এইটে পড়া, বাবলু-বিলুদেরও বয়স এমন কি!

অর্জুন যেরকম শ্রীকৃষ্ণের কাছে গীতামাহাত্ম শুনেছিলেন, আমিও সেরকম তাদের বাড়ির গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে সেই গোয়েন্দা দাদা'র কাছ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইলাম যে গোয়েন্দা হতে গেলে কিকি করণীয়! দেখলাম মন দিয়ে লেখা পড়া করতে হবে, খবরের কাগজ পড়তে হবে - এরকম কিছু ছন্ন-ছাড়া উপদেশ ছাড়া সে আর সেরকম কোনো কাজের জিনিষ বলতে পারলো না| সে কিকি 'কেস' এতদিনে 'সলভ' করেছে জানতে চাইলে সেরকম রোমহর্ষক কিছুই বেরুলো না| অবশেষে অনেক কুন্ঠাভরে জানতে চাইলাম যে একবার যদি তার 'পিস্তল'টা দেখানো যায় - দাদা যথেষ্ট বিব্রত হলো - মনে হলো যেনো বললো 'সেসব দুর্গাপুজো'র সময়ে হবে'!

যাতায়াত আর কথা বার্তা মিলে স্কুল ছুটি'র পরে আমি প্রায় আধা-ঘন্টার জন্যে নিখোজঁ - ভাবতেই পারছেন আমার মা ততক্ষণে সরেজমিন আমার অন্তর্ধান রহস্যের তদন্ত করা শুরু করে দিয়েছেন! আর এই তদন্তের সমাধান হতে আমার কি চমতকার দুর্গতিতাই না হয়েছিল!

অনেক বছর পরে আমরা তখন কলেজে বা স্কুলের শেষদিকে - ফের দেখেছিলাম সেই দাদাকে| আমি ওনাকে ভুলেই গিয়েছিলাম একরকম| রাস্তায় ওনাকে দেখে ভাবছিলাম যে কোথায় যেনো দেখেছি| পরে মনে পড়ল যে এই তো সেই আমার না হতে পারা আদর্শ! চেহারা একইরকম তবে সাইকেলের সামনে পিছনে ঝোলানো একগাদা প্যাকিং বাক্সো দেখে মনে হলো উনি সম্ভবত ফ্লাস্ক বা হট-পট বা ঐরকম কিছু'র ব্যবসা করেন|

যেরকমটা হওয়ার কথা ছিল সেরকম তো হলো না!

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

উত্তরাধিকার ওয়েব সাহিত্য পুরস্কার

একটু নয়, প্রচুর দেরি করেই – ইয়ে কি বলে আবার একটু ঢাক পেটাপিটি করি| তবে সেদিক থেকে ধরতে গেলে ভবিষ্যতে আমার ডিজে হওয়ার রাস্তাও খুলছে হয়তো পরোক্ষ ভাবে| আসল সাফাই হলো ‘আমার মতো’ যারা কাজ করেন, তারা হয়তো উপলব্ধি করেছেন যে এপ্রিল মে থেকে কাজের স্বাভাবিক চাপ শুরু হয় আর তা বাদে যেহেতু ব্যক্তিগত ভাবে আমার পুরস্কার-টুরস্কার পাওয়ার সেরকম অভ্যাস নেই, সেই দিক থেকে - তবে ঘটনা, একবছরে পরপর দুবার পুরস্কার প্রাপ্তি আর তার সাথে ইদানীন গপ্পো লেখারও ঝোঁক বেড়েছে খানিক, কাজেই সবে মিলে ... যাকগে! জ্ঞানীগুনী যারাই আছেন তাদের কাছে ব্যাখ্যা করার দরকার না হলেও, সাধারণ মানুষ হয়তো কৌতুহলী হবেন যে এই উত্তরাধিকার ওয়েব সাহিত্যের ব্যাপারটা কি! দেখুন, মানুষ একটি অদ্ভুত জন্তু – সেভাবে বলতে গেলে এদের রাম-টু-রম রেশিও অন্যান্য জন্তুর তুলনায় অনেক বেশি মানে একোয়ারড মেমরির থেকে প্রিন্টেড মেমরি অনেক কম| জীবন বিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা খুবই কম, তাও আমার সেকেন্ডারি ব্রেন, মানে ইন্টারনেট থেকে যা জানা, মানব মস্তিষ্কের ডানদিক আমাদের সাথে বেজায় মজার মজার খেলা খেলে! কল্পনা, সৃজনশীলতা – এগুলি অন্য জন্তুদের ভিতর সেভাবে প্রকট কি? হয়ত

নতুন এডভেঞ্চার

“সারাজীবন কলম পিষে কাটাতে চাও নাকি – হ্যাহ? ভালো!” সমুকে তার ব্যাগ থেকে তার বইয়ের পাঁজা বের করতে দেখে পল্টন বললো| “কেন? তুমি কি করতে চাও?” আশ্চর্য্য হয়ে জিজ্ঞাস করলো সমু| “আমার ভাই ওসব পোষাবে না – আমি চাই এডভেঞ্চার! সারাজীবন অফিস-কাছারিতে মুখ গুঁজড়ে পড়ে থেকে চাকরি বাকরি করা – এহে, সে আমার ধাতে নেই| যারা জীবনে চ্যালেঞ্জ নিতে পারে না, তাদের হয়তো … যাক গে!” হাত উল্টোল পল্টন| এরকম খাপছাড়া ছেলের সাথে একসাথে অনির্দিষ্ট কালের জন্যে একটা বাড়িতে একসাথে থাকতে হবে, সেটা ভাবলেই সমু রীতিমতো তিতিবিরক্ত হচ্ছে| কিন্তু এছাড়া তো আর কোনো উপায়ও দেখা যাচ্ছে না – সমু’র মাসি-মেসো তার মাসতুতো দিদির বাড়ি নিমন্ত্রনে গিয়েছে, মাসতুতো দাদা সৌগতকে ব্যবসার কাজে অন্য শহরে না গেলেই নয় – বাড়ি ফাঁকা| সমু কলেজ শেষ করে আপাতত বেকার, চাকরি-বাকরির পরীক্ষা দিচ্ছে, সৌগত তাকে বলেছিলো যে অন্তত মাসি-মেসো ফেরা অব্দি সে যদি তাদের বাড়ি থাকতে পারে| গ্রাজুয়েশনের পর থেকে এযাবত কেবল বাড়ি-কোচিং সেন্টার, কোচিং সেন্টার-বাড়ি করে সমুও হাঁফিয়ে উঠেছিলো, কাজেই এমন একটা আউটিংএর সুযোগ পেয়ে সেও লাফিয়ে উঠলো| সেই মতো সমু এক সপ্তাহের মতো জামাক

কিছু কিছু দেখা

আমি বেশি কিছু দেখিনি, কিন্তু কিছু কিছু দেখেছি - খুব ভালো লাগে| সে অনেক দিন আগের কথা ... উহু রুপকথা নয়, আমি তখন তিন চার বছর - কোলাঘাটে থাকি| আমার বাবা বাইকের ডায়নামো ডিসএসেম্বেল করছিলো - ওয়ারিং মনে রাখতে একটা কাগজে এঁকেও রাখছিলো সাথে সাথে| আমিও বাবার দেখা দেখি আরেকটা কাগজে সেই রকম আঁকিবুঁকি করতে শুরু করলাম| বাবা আমার বাহাদুরি দেখে পরের মাসেই আঁকার স্কুলে ভর্তি করে দিলো| সেই স্কুলে কিরকম কি দেখেছি, বেশিরভাগই ভুলে গেছি| তবে আমায় প্রথমেই একটা ইঁদুর আঁকতে দিয়েছিলো সেটা মনে আছে - আর সেটা 'কেন করবো' মনে করে নকল করতে করতে দেখছিলাম পাশে আর একটা বড় ছেলে 'ঘরের মধ্যে পড়তে বসেছে, এরকম একটা ছেলের লাল জামার নিচে সাদা প্যান্টে' আচ্ছা করে সাদা প্যাস্টেলই ঘসছে| আমি বোকার মতো জিজ্ঞাস করলাম 'কাগজেই তো সাদা আছে!' সে আমার বোকামি শুধরে দিলো - 'উহু আরও সাদা করতে হবে|' কিন্তু সেই ছবিতে কমলা ছাদ, খয়েরি বাক্স আর বাইরের কচি-কলাপাতা-সবুজ মাঠের ওপারে গাড় সবুজ ঝোপঝাড় দেখে খুব সুন্দর লেগেছিলো - মনে আছে| তারপর কি হলো জানিনা - মনে নেই আমার - পাঁচ বছর বয়সে বসিরহাট এলাম| ভাড়াব